লোকাল মার্কেটিং কিভাবে ব্যবসার জন্য লাভজনক হতে পারে?
লোকাল মার্কেটিং বা নেবারহুড মার্কেটিং হলো স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে নিজের বিপনী বা পরিষেবাকে জনপ্রিয় করে তোলা। যে স্থানীয় ব্যবসাটি শুধুমাত্র ৫০ মাইলের অন্তর্বর্তী জনসাধারণকে পরিষেবা দেয়, তার পক্ষে জাতীয় জনসংযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। এইরকম স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য লোকাল মার্কেটিং অত্যন্ত জরুরি।
আপনার সঙ্গে এরকম নিশ্চই হয়েছে কখনো, আপনি সকালবেলা চা খেতে গিয়ে খবরের কাগজ খুলেছেন আর অমনি একটি লিফলেট খসে আপনার কোলের ওপর পড়লো। আপনি খুলে দেখলেন আপনার পাড়ার খুব কাছেই একটি নতুন রেস্তোরা বা বিউটি পার্লার বা মুদির দোকান খুলেছে যেখানে দারুন লোভনীয় ছাড়ে আপনার কাঙ্খিত বস্তু বা পরিষেবা আপনি পেতে পারেন। আপনি খুব খুশি হলেন কারণ, এক হৃদয়গ্রাহী প্রস্তাব আপনার প্রিয় জিনিসের ওপর, দুই জায়গাটি আপনার বাড়ির কাছে, তিন আপনি এই নতুন খবরটি আপনার পরিবার বা প্রিয়জনকে বলে চমকে দিতে চান। এই ভাবে নিজের ব্যবসার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাকেই বলা হয় লোকাল মার্কেটিং।
লোকাল মার্কেটিংয়ের গুরুত্ব কি?
আপনি যদি পাশ্চাত্য দেশের কথা ভাবেন সেখানে বেশিরভাগ মানুষই লোকাল পরিষেবার প্রতি আগ্রহী। কারণ তাদের জীবনে সময়ের অভাব, আর প্রায় সব বড় বড় সংস্থারই প্রতিভূ বা ফ্রাঞ্চাইজি কাছে পিঠে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ক্রেতা জোগাড় করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। আগের প্রজন্ম তাও স্থানীয় জিনিসের ওপর অনুগত বেশি ছিল কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম খোঁজে আরো ভালো আরো আন্তর্জাতিক আরো উচ্চকোটির জিনিস। তারা ২ ঘন্টা সময় ব্যয় করে পৌঁছে যায় স্টারবাক্সে কফি খেতে, গাড়ি চালিয়ে যায় শপিংমলে আদিদাস বা রিবক কিনতে। সোশ্যাল মিডিয়া আর আধুনিকতা তাদের করে তুলেছে উঁচু দরের উপভোক্তা যারা বেশি দাম দিয়ে ভালো জিনিসটা কিনতে রাজি। আর আরামজনক সুবিধের কথা যদি না বলি তাহলে অনেকে বুঝতে পারবেনা কেন এখনকার যুব সম্প্রদায় জামাকাপড়, শাকসবজি মায় টুথব্রাশ পর্যন্ত বাড়িতে বসে কিনছে । দশ বছর আগেও এতটা ভাবা যেতোনা। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির সাথে দিনকাল পাল্টেছে আর পাল্টেছে সমাজের ব্যয় করার মনোভাব। এইরকম পরিস্থিতে আপনার স্থানীয় ব্যবসাটি দাঁড় করাতে গেলে আপনাকে লোকাল মার্কেটিং স্ট্রাটেজি নিয়ে ভাবতেই হবে।
লোকাল মার্কেটিংয়ের উদাহারন:
ইমেল লিস্ট:
অনেক সংস্থা দূরদর্শিতা দেখিয়ে অনেক আগে থেকেই এই পদ্ধতি চালু করেছিল শুধুমাত্র কাস্টমার রিটেনশনের জন্য। যেমন একটি বিখ্যাত মুক্তোর গয়নার বিক্রেতা তাদের প্রতিটি দোকানে সি আর এম বা কাস্টমার রিলেশন ম্যানেজমেন্ট সফ্টওয়ার দিয়ে নথিভুক্ত করে রাখতো তাদের ক্রেতাদের জন্মদিন ইত্যাদি। এইরকম দিনগুলিতে ক্রেতারা পেতো একটি ইমেল বা এসএমএস যেখানে তাদের অভিনন্দন জানিয়ে তাদের মনে নিজের ব্যবসার একটি সদর্থক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী।
ইভেন্ট বা স্ট্রিট টিম:
কিছু ভারপ্রাপ্ত কর্মী লিফলেট বিলি করে বিভিন্ন জায়গায় কোনো একটি বিপনী বা সংস্থার হয়ে। কখনো ইভেন্ট বা বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় শুধুমাত্র কিছু উপহার আর বিনোদনের মাধ্যমে ব্যবসার পরিচিতি ছড়াতে আর ক্রেতার তথ্য সংগ্রহ করতে যেমন নাম ধাম, বয়েস, জন্মদিন ইত্যাদি।
ডিজিটাল দিগন্ত:
এতক্ষনে আপনি নিশ্চই বুঝে গেছেন বর্তমান যুগে শুধু মাত্র এই কয়েকটি মার্কেটিং পদ্ধতি অবলম্বন করে চললে হবে না। যুগোপযোগী হতে গেলে আপনার ব্যবসার উপস্থিতি অতি অবশ্যই থাকতে হবে অন্তর্জালে বা ইন্টারনেটে যা একটি মাত্র সার্চ করলেই উঠে আসবে প্রতিটি মানুষের ফোন না ল্যাপটপের স্ক্রিনে। লোকাল সার্চ মার্কেটিং বা লোকাল এস ই ও এমন একটি পদ্ধতি যা নিশ্চিত করে আপনার ব্যবসার উপস্থিতিকে সার্চ রেসাল্ট, লোকেশন পেজে বা অনলাইন ম্যাপে। সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদির বিভিন্ন মঞ্চে থাকতে হবে আপনার ব্যবসার প্রতিমূর্তি।
ক্রেতার শ্রেণীবিভাগ:
আপনি যদি একটি স্থানীয় কফি শপ খোলেন, বাংলা দৈনিকের সাথে বিজ্ঞাপন বিলি করে আপনার যতটা লাভ হবে অনলাইন উপস্থিতি দেবে তার থেকে বেশি। আবার আপনার যদি একটি ছেলেদের সেলুন হয় রাস্তার চায়ের দোকানের সামনে লিফলেট বিলি করলে কাজ দেবে। আসল কথা হলো শুধু ক্রেতাকে আকর্ষণ করাই নয় আপনার মার্কেটিং স্ট্রাটেজিতে থাকতে হবে আপনার টার্গেট কাস্টমার কারা এবং কিভাবে তাদের কাছে পৌঁছনো যায়।
জনসংযোগ:
জনসংযোগের বিভিন্ন মাধ্যম আছে ইন্টারনেট ছাড়াও। আপনি যখন আপনার টার্গেট কাষ্টমেরকে চিনতে পেরেছেন তখন আপনার প্রচার বা বিজ্ঞপ্তির বয়ানটি সেইরকম করে টেলারমেড করুন ও যথাযত জনসংযোগ মাদ্ধমে ছড়িয়ে দিন। একটি উদাহারন দিচ্ছি। আপনি যদি একটি ওষুধের দোকান চালান তাহলে অবশ্যই, কাগজ ও বেতার মাধ্যমকে ভুলবেন না।
রাজা ক্রেতা:
ভাবমূর্তি গড়ে তোলা ও রক্ষা যেহেতু লোকাল মার্কেটিংয়ের অন্তর্নিহিত প্রথম উদ্দেশ্য সেহেতু অবশ্যই খেয়াল রাখবেন আপনার বা আপনার কর্মচারীদের, ক্রেতার সাথে ব্যবহার যেন কোনো মতেই রূঢ় না হয়ে পড়ে। লোকমুখে দুর্নাম কিন্তু সুনামের আগে ছড়ায়।
অভিনবত্ব:
বিদেশে কুপন প্রথার ভীষণ প্রচলন আছে। কুপন দেখিয়ে যেমন অনেক টাকা বাঁচাতে পারে ক্রেতারা সেরকম অনেক লোক যখন কুপন সংগ্রহ করে কেনাকাটি করে, ব্যবসার যেমন লাভ হয় তেমনি প্রচারও হয়। ভাবুন এরকম আর কি ভাবে আপনি ক্রেতাকে কাছে টানতে পারেন।
এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো। আপনার ব্যবসার প্রকৃতির ওপর কিন্তু নির্ভর করবে সেটি স্থানীয় লোকদের কত টা আকর্ষণ করতে পারবে। একটি পারিবারিক রেস্তোরা যতটা স্থানীয় লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে একটি পাব বা বার হবে না।
বর্তমান পরিস্থিতি তে কি করবেন:
যেকোনো ব্যবসার মার্কেটিংয়ের ওপর করোনা আবহের প্রকোপ পড়তে বাধ্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে অস্তিত্ব রক্ষা করাটাই আসল। স্বাস্থ নিয়মবিধি মেনে আপনি কাজ করছেন সেটি বার বার মানুষকে জানান। প্রচার করুন। অনুগত ক্রেতাদের অনুরোধ করুন তারা যেন আপনার নিরাপদ পরিষেবা ও স্বাস্থ বিধি মেনে কাজ করার কথা ভাগ করে নেন সবার সাথে তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে।
নিজের পরিষেবাটি ভালো রাখুন, বিধি নিষেধের খেয়াল রাখুন আর অতি অবশ্যই যত্ন নিন আপনার কর্মচারীদের। এরাই কিন্তু আপনার প্রথম ক্রেতা। এরা কিনছে এদের জীবিকা আপনার কাছে। এরাও স্থানীয় মানুষ। এরাই আপনার প্রথম জনসংযোগ, প্রথম প্রতিনিধি। এরা বিনামূল্যে আপনার ব্যবসার ভাবমূর্তি গড়ে তোলে আপনার অজান্তে, যদি আপনার কাছে এরা ন্যূনতম সুখ সুবিধা টুকু পায়।
সবশেষে বলি উৎসবের দিনগুলিতে কিরকম বিক্রি হতে পারে তার একটা আন্দাজ করে রাখুন। সব সম্প্রদায়ের, ছোট বড় উৎসবে বিক্রীবাটার চড়াই উৎরাই এর জন্য তৈরী থাকুন। আগে থেকে জানাতে থাকুন সবাইকে আপনি কি বিশেষ পরিষেবা আনতে চলেছেন উৎসবের দিনগুলিতে। আপনি যদি একটি পার্লার চালান, তাহলে ফোন করুন আপনার অনুগত ও স্থায়ী খদ্দেরকে। যদি বুটিক হয় আপনার ব্যবসা, নতুন সংগ্রহের জন্য খবর নিন ফেসবুক পেজে কিরকম পোশাকের চাহিদা তৈরী হয়েছে এখন। যদি একটি ওষুধের দোকান চালান আপনি তাহলে বিজ্ঞপ্তি দিন কোন কোন সময় দোকান খোলা রাখছেন। সাম্প্রতিক কালের কথা মাথায় রেখে চলবেন। ভেঙে পড়বেন না। মনে রাখবেন আপনার স্থানীয় ক্রেতাদের যে ব্যক্তিগত বাড়তি সুবিধে বা পার্সোনাল টাচ দিতে পারেন তা বড় বড় সংস্থা পারেনা। আপনি জানেন, কার বিরিয়ানির সাথে বাড়তি পেঁয়াজ লাগে, কার বর্ষাকাল এলে ভূতের বই দরকার, কে রোগা হওয়ার পর থেকে সালোয়ার ছেড়ে জিন্স পড়ছে। খদ্দেরকে শুধু ব্যবসা ভাববেন না। সুসম্পর্ক তৈরী করুন। এগিয়ে যান নতুন ভাবনা নিয়ে। আর দেশ ও এখন ভোকাল ফর লোকাল। তাহলে আর ভাবনা কি?