মোমবাতি তৈরির ব্যবসায় কীভাবে শুরু করবেন
দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করা বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে মোমবাতি অন্যতম। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কাছে এর কদর রয়েছে। অল্প খরচে আলো পেতে মোমবাতি খুবই উপকারী পণ্য। মোমবাতি আলো দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, জন্মদিন, এমনকি শোপিস হিসেবে নানা রং ও আকৃতির মোমবাতি ব্যবহার করা হয়। শুধু তাই নয় আজকাল রেস্টুরেন্ট গুলোতেও ক্যন্ডেল লাইট ডিনারের অন্যতম সেরা সরঞ্জাম মোমবাতি। অর্থাৎ এর চাহিদা রয়েছে। তাই মোমবাতি তৈরির ব্যবসায় যুক্ত হতে পারেন আপনিও। বেকার নারী বা পুরুষ নিজের কর্মসংস্থানের জন্য মোমবাতি তৈরির ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
সুবিধা
এই ব্যবসা শুরু করতে তুলনামুলকভাবে অনেক কম পুঁজির দরকার পরে। খুব সহজেই মোমবাতি বানানো শেখা যায়। মোমবাতি বানানোর কারখানা অল্প জায়গাতে আরম্ভ করা যায়। তাই শহর বা গ্রামে সব জায়গায় এই ব্যবসা করা যায়। কোন কর্মী না রেখে পরিবারের সবাই মিলে ব্যবসাটি পরিচালনা করা সম্ভব। সারা বছর জুড়ে কমবেশি সকল শ্রেনীর মানুষের কাছে এর চাহিদা থাকে। মোম্বাতির ব্যবসাটিতে লাভও অন্যন্য ব্যবসার থেকে অনেক বেশি। মোমবাতি নেজেই দোকান দিয়ে বিক্রি করা যায় তাছাড়া খুব সহজেই পাইকার বা খুচরা দোকানদারদের কাছে বিক্রি করা যায়।
মোমবাতি বানানোর উপকরণ
ডাইস, প্যারাফিন, কড়াই, পাত্র, ছুরি, কাঁচি, চামচ, মগ, বালতি, তুলি, স্টোভ প্রভৃতি দিয়ে আজকাল নিত্য নতুন মোমবাতি হাতেই বানানো হচ্ছে।
কাঁচামাল
সাদা মোম, ইস্টারিক এসিড, সুতা, রং, সয়াবিন তেল, প্যাকেট, লেবেল, আঠা প্রভৃতি জিনিস দিয়ে মোমবাতি বানানো হয়ে থাকে।
মোম তৈরির পদ্ধতি
প্রথম ধাপ: মোম তৈরির ডাইস বা ছাঁচের দুটি অংশ একটি ছিঁটকিনি দিয়ে আটাকানো থাকে। এবং ডাইসের ভিতরে মোমবাতি আকৃতির কত গুলো খাঁজ থাকে। প্রথমে ডাইসের ছিটকিনি খুলে ছাঁচের দুইটি অংশ আলাদা করতে হবে। এরপর একটি কাপড়ে তেল নিয়ে ডাইসের ভিতরে থাকা খাঁজগুলো ভালো ভাবে মুছে নিতে হবে, যাতে করে মোমগুলো খুব সহজে বের করা যায়।
দ্বিতীয় ধাপ: ছাঁচের মধ্যে সলতে পরানোর জায়গা রয়েছে। সলতেগুলো উপর থেকে নিচ পর্যন্ত টান টান করে বেঁধে দিতে হবে।
তৃতীয় ধাপ: এরপর ছাঁচের ২টি অংশ এক সাথে আটঁকে দিতে হবে এবং ছাঁচের সাথে লাগানো পানির ট্যাংকে পানি ভরতে হবে। কারণ পানি ভরা থাকলে গরম মোম ঠান্ডা হতে সহজ হয়।
চতুর্থ ধাপ: এবার চুলায় কড়াই বসাতে হবে। কড়াই গরম হলে তার মধ্যে সাদা শক্ত মোম (প্যারাফিন) দিতে হবে। মোম পুরোপুরি গলে যাবার আগেই কড়াইতে ১০ ভাগ মোমের সাথে ১ ভাগ স্টিয়ারিক এসিড মিশাতে হবে।
পঞ্চম ধাপ: প্যারাফিন গলে যাবার পর বেশিক্ষণ চুলায় রাখা যাবে না। কারণ গলে যাওয়া প্যারাফিন বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে পারে।
ষষ্ঠ ধাপ: গলা মোম মগে বা চামচে করে আস্তে আস্তে মেশিনের খাঁজগুলোতে ঢালতে হবে।
সপ্তম ধাপ: মোম ঢালার খাঁজটি যতক্ষণ না পুরোপুরিভাবে ভরবে ততক্ষণ পর্যন্ত মোম ঢালতে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মোম ঢালার সময় খাঁজের ভেতরে যেন কোন ফাঁকা থেকে না যায়।
অষ্টম ধাপ: ২০২৫ মিনিট পর মোমগুলো ঠান্ডা হলে ছাঁচের ২টি অংশ আলাদা করে মোমগুলো বের করে আনতে হবে। নবম ধাপ: এবার মোমের সলতের বাড়তি অংশগুলো সাইজ মত কাটতে হবে এবং মোমবাতি ভালোভাবে বসানোর জন্য নিচের অংশের তলাটি সমান করে কাটতে হবে। বিভিন্ন আকৃতির নকশা করা মোম তৈরির জন্য সেই অনুযায়ী ছাঁচ তৈরি করতে হয়।
সাবধানতা
স্টিয়ারিক এসিড মোমের সঙ্গে মেশানোর সময় সাবধান থাকতে হবে। মোম চুলায় কড়াই থাকা অবস্থায় রং মেশানো যাবে না। চুলা থেকে নামিয়ে রং মেশাতে হবে। মোমবাতি তৈরির সময় অবশ্যই শিশুদের নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে। যাইহোক মোমবাতি বানানোর কাজ শেষে মোমের ছাঁচটি পরিষ্কার করে রাখলে সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
কর্মীর দরকার আছে কিনা
মোমবাতি বানানোর কারখানায় দক্ষ কারিগরের প্রয়োজন রয়েছে। আপনি নিজেই যদি দক্ষ কারিগর হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাজটি শেখাতে পারেন। এতে আপনার উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। অন্যথায় আপনি কারখানায় দক্ষ কর্মী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় আপনার ব্যবসায় লোকসান হতে পারে। মনে রাখবেন দক্ষ কর্মী যত বেশী থাকবে উৎপাদন তত বেশি বাড়বে। অন্যদিকে যদি মেশিন দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে চান তবে মেশিন চালাতে পারে এমনই একজন বাদুড় মানুষের দরকার পড়বে।
প্রচার-প্রচারণার দরকার আছে কিনা
যেকোন ব্যবসা শুরু করতে হলে প্রচার-প্রচারণার দরকার রয়েছে। আপনার এলাকায় ফেস্টুন লাগিয়ে বা পোস্টার লাগিয়ে ব্যবসার প্রচার করতে পারেন। ব্যবসাটি প্রচার করতে ব্যবহার করতে পারেন ডিজিটাল মাধ্যম। সেক্ষেত্রে ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার ব্যবসাকে প্রমোট করতে পারেন। এছাড়াও নিজ এলাকায় মাইকিং করতে পারেন। এতে করে আপনার ব্যবসা যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনই উত্তর উত্তর অজানা উত্স থেকে আপনার গ্রাহক সংখ্যা বাড়তে থাকবে। তবে মনে রাখবেন যত ভালো মানের পণ্য সরবরাহ করবেন তত বেশি গ্রাহক আপনার ব্যবসার পণ্যে আস্থা রাখবে।
কেমন পুঁজি দরকার পরে
পুঁজির বিষয়টা আসলে আপনি কতটা বড় করে ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন তার উপরে নির্ভর করে আপনি যদি ব্যবসাটা খুব বড় করে শুরু করতে চান তবে অধিক পুঁজির প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও যদি মেশিন দিয়ে মোমবাতি বানানোর কাজ সমাধা করতে চান তবে মেশিন কেনার খরচা তো রয়েছেই। কারখানা জায়গাটা যদি আপনার নিজস্ব না হয় তবে কারখানা ভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ এর সকল এর দরকার হবে। যদি আপনাকে কর্মী রাখতে হয় তবে কর্মীর মাসিক বেতনের দরকার রয়েছে। আর যদি আপনি নিজে মোমবাতি বানানোর কাজে দক্ষ হন এবং নিজের কারখানা জন্য ছোট একটি জায়গা থাকে তবে খুব কম বিনিয়োগ করে আপনি ব্যবসা শুরু করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আট হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে প্রাথমিকভাবে ব্যবসাটি শুরু করতে পারেন।
কেমন মুনাফা লাভ হয়
দিনে ২৫০টি মোমবাতি তৈরি করে বিক্রির পর খরচ বাদে ছয়শ টাকা লাভ করা সম্ভব। হিসাবটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের বাজারদরের ভিত্তিতে করা।
তবে কাঁচামাল ও জিনিসপত্রের দাম ওঠানামার সঙ্গে এই হিসাবটির হেরফের হতে পারে।
প্রশিক্ষণ দরকার আছে কি না
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, যুব উন্নয়ন অধিদফতর ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের জন্য মোমবাতি তৈরিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
বাজার সম্ভাবনা
মোমবাতি তৈরি করে নিজ এলাকা বা এলাকার বাইরে মুদি দোকানগুলোয় পাইকারিতে বিক্রি করা যেতে পারে। বিভিন্ন আকৃতির নকশা করা নানা রঙের মোমবাতির চাহিদা শহরেই বেশি দেখা যায়। এ-জাতীয় মোমবাতি শহরের শৌখিন পণ্য বিক্রির দোকানেও সরবরাহ করা যেতে পারে।
আজকাল মোমবাতিগুলো রেস্টুরেন্টে খুব চালে। রেস্টুরেন্টগুলোতে রোমান্টিক আবহাওয়া তৈরি করতে মোমবাতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়াও মসজিদ-মন্দির বা ধর্মীয় উৎসব এবং প্রতিষ্ঠানে মোমবাতির ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। অন্যদিকে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায় সেদিকে মোমবাতির চাহিদা ব্যাপক। তাছাড়া জন্মদিন সহ যেকোনো ধরনের কেক কর্তনের বেলায় মোমবাতির ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। এছাড়াও যে কোনো প্রতিবাদ সমাবেশ এবং মিছিলে আমরা মোমবাতির ব্যভার দেখতে পাই। তাই মোমবাতির ব্যবসার বড় এক বাজার সম্ভাবনা রয়েছে।
মোমবাতির ব্যবসা একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। তাই আপনি যদি খুব দক্ষতার সাথে ব্যবসাটি পরিচালনা করতে পারেন তবে আপনি খুব তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠিত একজন উদ্যোক্তা হতে পারবেন। তাছাড়া ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির দরুন মোমবাতির চাহিদা ব্যপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিত্য নতুন কাজে মোমবাতির ব্যবহার আজকাল প্রচুর বেড়েছে। তাই আপনি চাইলে খুব স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে এমন একটি ব্যবসা মালিক বনে যেতে পারেন।