ভারতীয় অর্থনীতিতে জিএসটির প্রভাব কী?
জিএসটি অর্থাৎ গুডস এন্ড সার্ভিস ট্যাক্স অথবা পণ্য পরিষেবা কর ভারতবর্ষে চালু হয়েছিল ১st জুলাই ২০১৭ সালে। যে দ্রব্য গুলি পরিমাপযোগ্য সেগুলি গুডস ট্যাক্স এর অন্তর্ভুক্ত এবং যে প্রোডাক্টগুলি পরিমাপযোগ্য নয় সেগুলিতে সার্ভিস ট্যাক্স আরোপিত করা হয়। জিএসটি চালু হওয়ার আগে আমাদের দুই ধরণের ট্যাক্স বা কর দিতে হতো। এই ট্যাক্সগুলিতে রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার দুটোরই ভাগ থাকতো। রাজ্য সরকার সরাসরিভাবে সার্ভিস ট্যাক্স, ক্যাপিটাল গ্রীন ট্যাক্স, কর্পোরেট ট্যাক্স গ্রহন করতো আর অপরদিকে পরোক্ষভাবে সেলস ট্যাক্স, কাস্টম ডিউটি টোল ট্যাক্স এগুলি কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করতো, তবে কিছুটা অংশ রাজ্য সরকারও লাভ করতো।পার্থক্য হলো রাজ্য সরকারকে বাধ্যবাধকতার সাথে করগুলি দিতে হতো এবং পরোক্ষ ট্যাক্সের ক্ষেত্রে যখন দ্রব্যগুলি বা সার্ভিসগুলি আমরা নিতাম সেখানে করগুলি ইনক্লুড করে দেয়া হতো। এগুলি বিক্রেতার মারফত সরকারের কাছে যেত।
কিন্তু যখন জিএসটি চালু হয় এই দুটি করকে একত্র করে দেয়া হয়, সমান ভাগে রাজ্য এবং কেন্দ্রে ভাগ হওয়ার জন্যে। এখানে অনুমোদনগুলিকে একটি সিঙ্গেল কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। জিএসটি কে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি কেন্দ্রীয় সরকারের পণ্য পরিষেবা কর, পরের টি রাজ্য সরকারের পণ্য পরিষেবা কর, এবং শেষেরটি সমন্বিত সরকারের পণ্য পরিষেবা কর। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পণ্য বিক্রয় করার জন্যে সমন্বিত পণ্য পরিষেবা কর বা ইন্টিগ্রেটেড জিএসটি দিতে হয়। তবে ইন্টিগ্রেটেড জিএসটি থেকেও রাজ্য এবং কেন্দ্র সমান ভাগে তাদের কর বন্টন করে। ব্যাবসায়ীদের সাথেই মূলত জিএসটি সম্পর্কিত যেহেতু তারা পণ্য বিক্রয়ের সাথে সরাসরি যুক্ত। এক একটি পণ্য বা দ্রব্যের উপর বিভিন্ন হরে জিএসটি প্রয়োগ করা হয়েছে। আবার এই করের বাইরেও বেশ কিছু পণ্য আছে যেগুলির জন্যে কোনো করের প্রয়োজন হয় না।সারা দেশের যেখান থেকেই জিনিস ক্রয় করা হোক কোনো ক্রেতাকে একবারই কর দিতে হবে। যে ব্যাবসায়ীদের বছরে ২০ লাখের ওপর ক্রয়বিক্রয় হয় তাদের ক্ষেত্রে এই জিএসটি নাম্বার প্রযোজ্য। মাসে ৩বার রিটার্ন ফাইল করার নিয়ম আছে এই জিএসটি তে। এর ফলে কোনো ট্যাক্স চুরি যাওয়ার ভয় থাকে না। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ব্যাপারটি সম্পাদিত হয়।
কিন্তু পুরো পদ্ধতিটি চালু হওয়ার পর যে সুফল টি ভাবা হয়েছিল সেই রকম হয়নি।আর ভারতবর্ষে অর্থনীতির ওপর জিএসটির প্রভাব কিছুটা নেগেটিভ এবং কোনো কোনো দিক থেকে সদর্থকও বলা যায়। এই বছরে করোনার প্রভাবও জিএসটির ওপর পড়েছে। অনেক লোকের উপার্জন কমে যাওয়ার ফলে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া অন্য কোনও জিনিস কিনছে না। ফলে জিএসটির ওপরও এর খারাপ প্রভাব পড়ছে।আর্থিক কাজকারবার কমে যাওয়ার দরুন পণ্য ও পরিষেবা দুইটি ক্ষেত্রই মার খাচ্ছে।
ভারতীয় অর্থনীতিতে জিএসটির প্রভাব
কর কাঠামোর সরলীকরণ:
জিএসটি দেশের কর ব্যবস্থা সহজ ও সরল করেছে, যেহেতু জিএসটি একক কর, তাই সাপ্লাই চেইনের একাধিক পর্যায়ে করের গণনা করা সহজ হয়ে গেছে। এর মাধ্যমে গ্রাহক এবং নির্মাতারা উভয়ই তাদের কাছ থেকে নেওয়া ট্যাক্সের পরিমাণ এবং এর ভিত্তির একটি পরিষ্কার ধারণা পান। এর সাথে কর কর্মকর্তা ও কর্তৃপক্ষ পরিচালনার ঝামেলাও এড়ানো যেতে পারে।
উৎসাহের সাথে উৎপাদন–
ভারতীয় খুচরো শিল্প অনুসারে, সমগ্র করের পরিমাণটি পণ্যের ব্যয়ের প্রায় 30% এবং জিএসটির প্রভাবের কারণে করগুলি হ্রাস পেয়েছে। সুতরাং, শেষ গ্রাহককে কম কর দিতে হবে। কমে যাওয়া করের পরিমাণকে বর্ধিত করা হয়েছে এবং অন্যান্য শিল্পের উৎপাদনও বৃদ্ধি করা হয়েছে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে, ক্ষুদ্র–উত্পাদক এবং ব্যবসায়ীদের মতো স্বল্প–সমৃদ্ধ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে জিএসটি সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের হাতে রয়েছে। সামগ্রিক সম্মতি ব্যয় হ্রাস করার উপায়গুলি খুঁজে পেতে হবে এবং জনসাধারণের ভালোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলি করতে হতে পারে।
করের পরিমান–
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলি এখন জিএসটি দ্বারা প্রবর্তিত সংমিশ্রণ প্রকল্পের আওতায় নিজেদের যোগদান করতে পারে। এই স্কিমের মাধ্যমে, তারা তাদের বার্ষিক টার্নওভার অনুযায়ী কর প্রদান করবে। সুতরাং, ব্যবসায়িক টার্নওভারগুলিকে ১.৫ কোটি টাকা পরিমানের উপর বার্ষিক 1% জিএসটি দিতে হয়। তদুপরি, অন্যান্য সংস্থাগুলির যাদের বার্ষিক ৫০ লক্ষ টাকার ওপরে ইনকামের পরিমান জিএসটি হিসাবে তাদের ৬% হিসাবে কর দিতে হয়।
প্যান ইন্ডিয়া অপারেশনকে বর্ধিত করা হয়েছে–
সংস্থাগুলি এখন টোল প্লাজা এবং চেক পোস্টের মতো ট্যাক্স রোডব্লকগুলি কে এড়াতে পারবেন। এর আগে, এই রকম অপ্রকাশিত পণ্যগুলি পরিবহনের সময় অন্যান্য সমস্যা তৈরি করেছিল এবং তাতে ক্ষতিও হইছিল। সুতরাং, এই ক্ষয়ক্ষতিগুলি পূরণ করতে উৎপাদনকারীদের বাফার স্টক রাখতে হয়েছিল। সংরক্ষণ ও গুদামজাতকরণের এই ওভারহেড ব্যয়গুলি তাদের লাভের পরিমাণকে কমিয়ে দিয়েছিলো। একটি একক কর ব্যবস্থা এই সমস্যাগুলি হ্রাস করেছে। তারা এখন ভারত জুড়ে সহজেই তাদের পণ্য পরিবহন করতে পারে। এর ফলে তাদের প্যান ইন্ডিয়া অপারেশনগুলির উন্নতি হয়েছে।
রফতানি বৃদ্ধি:
জিএসটি পণ্য রফতানিতে শুল্ক হ্রাস করেছে।তাই জিএসটির কারণে স্থানীয় বাজারে উত্পাদন ব্যয়ও হ্রাস পেয়েছে।এই সমস্ত কারণেই দেশে রফতানির হার বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের বিষয়টি সংস্থাগুলিকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে।জিএসটি প্রবর্তনের ফলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের করগুলিকে একত্ৰিত করতে সহায়তা করেছে। এটি একাধিক করের ক্যাসকেডিং প্রভাব সরিয়ে দিতে সহায়তা করেছে। সুতরাং, সংস্থাগুলির এবং গ্রাহকদের জন্য করের বোঝা হ্রাস পেয়েছে। শুধু এটিই নয়, করদাতারা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছেন এবং তাই, করের রাজস্বও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সামগ্রিক কর ব্যবস্থা এখন পরিচালনা করা আরও সহজ। এছাড়াও, ছোট এবং মাঝারি আকারের উদ্যোগগুলি তাদের ব্যবসা উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা হচ্ছে যে জিএসটি আরও বেশি ভারতীয় সংস্থাকে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করবে। মাঝারি মেয়াদে সামগ্রিক অর্থনৈতিক সূচকগুলিতে জিএসটির প্রভাব খুব ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। করের ক্যাসকেডিং (করের উপর কর) প্রভাব হ্রাস হওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাবে। সরকারের পক্ষে করের থেকে আয় বাড়ানো সম্ভবত বর্ধিত সামগ্রিক করের মাধ্যমে বৃদ্ধি পাবে আসা করা যায় এবং আর্থিক ঘাটতি পরিবর্তনের আওতায় থাকবে বলে ধরা যায়।
এককথায়
জিএসটি ভারত বর্ষের কর ব্যাবস্থাকে সংস্কার করার জন্যে একটি বৃহত্তম প্রচেষ্টা বলা যায়। সমস্ত রকমের দ্বন্দ্ব কে পরিত্যাগ করে “একটি দেশ, একটি বাজার, একটি কর” এই ধারণার ভিত্তিতে জিএসটি কে ভারতবর্ষে প্রবর্তিত করা হয় এবং অবশেষে আজ আমরা এখানে পোঁছেছি। ভারত সরকারের এক দশকের অপেক্ষার সমাপ্তি হয়েছিল ২০১৭ সালের ১st জুলাই। সেই মুহূর্তটি অবশেষে এসে পৌঁছেছে একক বৃহত্তম পরোক্ষ কর ব্যবস্থার মাধ্যমে। এটি কার্যকর হওয়ার ফলে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্ত বাধা দূর করেছে। জিএসটি রোলআউট, একক স্ট্রোকের সাহায্যে ভারতকে ১.৩ বিলিয়ন নাগরিকের একীভূত বাজারে রূপান্তরিত করেছে। মূলত, ২.৪–ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ শুল্ক বাধাগুলি সরিয়ে কেন্দ্রীয়, রাজ্য এবং স্থানীয় ট্যাক্সকে একত্রিত জিএসটিতে রূপান্তর করার চেষ্টা করছে।
এই রোলআউট ভারতের আর্থিক সংস্থান কর্মসূচিকে পুনরায় গতি দান করাতে পারে এবং অর্থনীতিকে প্রশস্ত করার প্রত্যাশা নতুন করে তুলেছে। তবে এটিও বলা যায় এখানে খুব তাড়াহুড়ো রূপান্তর হিসাবে বিবেচনা করলে সম্পূর্ণ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা দেশের স্বার্থকে কখনোই সহায়তা করতে পারে না। ২৯ টি রাজ্য এবং ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে একসাথে জিএসটি বাস্তবায়নের পিছনে ধারণাটি ছিল এটি সবার জন্য একটি সমান পরিস্থিতি সরবরাহ করা। উৎপাদনকারী এবং ব্যবসায়ীদের জন্যেও কম ট্যাক্স ফাইলিং, স্বচ্ছ নিয়ম এবং সহজ বুককিপিংয়ের মাধ্যমে উপকৃত করা, ভোক্তাদের পণ্য ও পরিষেবার জন্য তুলনামূলক কম অর্থ প্রদান করা এবং রাজস্বর সাথে সাথে সরকারের আরও বেশি মুনাফা অর্জন হবে। এটাই ঘটনা যে যেটা ভাবা হয়, বাস্তব তার থেকে আলাদা হয়। জিএসটি তখনই সহজ এবং সরল হয়ে উঠবে, যখন পুরো দেশটি এটি সফল করার দিকে সামগ্রিকভাবে কাজ করবে।