কিভাবে বইয়ের দোকান ব্যবসা শুরু করবেন
শিক্ষিত জাতি সমাজ ও দেশ গঠনের কারিগর। আর শিক্ষিত জনসমাজ গড়তে হলে দরকার শিক্ষিত নাগরিক আর এর জন্য দরকার পুস্তক এবং বাহ্যিক জ্ঞান। ডিজিটাল পুস্তকের ধারণাটি ব্যাপকতা লাভ করলেও কাগজের পুস্তকের চাহিদা কিন্তু কমে যায় নি বরং আরও বেশী বেড়েছে। মানুষ মোবাইল,ট্যাব,ল্যাপ্টপ, ডেক্সটপের স্ক্রিনে পড়ার চেয়ে কাগজের বই পড়ায় বেশী স্বাচ্ছন্দবোধ করে। আমাদের দেশের সব জায়গাতেই কমবেশি এই ব্যবসার প্রচলন থাকলেও অন্যন্য ব্যবসার মতো এতো বেড়ে উঠেনি। যার ফলে জ্ঞান পিপাষু মানুষেরা আজো জ্ঞান অর্জন করতে শহরমুখী ভালো বই এর দোকানের দিকে ঝুঁকে আছে। বর্তমান সময়ে অনলাইন মার্কেট গুলেতোও কিন্তু বই ভালো কেনাবেচা হয়। তাই এই সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে তুমিও বনে যেতে পারো একজন সফল উদ্যোক্তা।
ব্যবসাটি কিভাবে শুরু করবে?
বইয়ের দোকান শুরু করতে সর্বপ্রথম তোমার লাগবে ট্রেড লাইসেন্স অর্থাৎ ভারত পুস্তক প্রকাশনী ও বিক্রেতার সমিতিভুক্ত লাইসেন্স। অন্যথায় তুমি বই বিক্রি করতে পারবে না। এছাড়া ব্যবসা শুরু করতে হলে তোমাকে অবশ্যই গ্রাহকের চাহিদা বুঝতে হবে অর্থাৎ কখোন কোন সময়ে কোন বইয়ের চাহিদা বেশি হবে তা বুঝে আগেই বই কিনতে হবে। তুমি কি ধরনের বই নিয়ে ব্যবসা করবে তা সম্পূর্ণ তোমার ক্রেতাদের চাহিদার উপর নির্ভর করবে। আর তুমি যে ধরনের বই নিয়ে ব্যবসা করবে তার ওপর নির্ভর করেই তোমার দোকানের লোকেশন ঠিক করতে হবে।
তুমি যদি এ ব্যবসাটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে শুরু করতে চাও তাহলে তোমার কোন দোকান ভাড়া নেওয়ার কোন প্রয়োজন হবে না। প্রয়োজন পরবে না বই কেনারও। শুধু অর্ডারগুলো নিয়ে কোন এক পাইকারী বই এর বাজারে বা প্রকাশনীর কাছে গিয়ে বই কিনে তোমার ওয়েবসাইটের নির্দিষ্ট প্যাকেটে প্যকেজিং করে ক্রেতার নিকট পাঠাতে হবে। এতে করে তোমার কিছু কর্মী নিয়োগ করতে হবে যারা একি সাথে বই কেনা ও হোম ডেলিভারির কাজটি নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করবে।
লোকেশন কোথায় হওয়া উচিত?
ব্যবসার লোকেশন কোথায় হওয়া উচিত তা সবসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বই বিক্রির জন্য সবচেয়ে ভালো লোকেশন হলো স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির পাশে। কারণ এসব জায়গায় সাধারণত বই বিক্রি বেশি হয়। আর এজায়গা গুলো হবে তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট।তুমি যদি ব্যবসাটি পাইকেরি হিসেবে চালাতে চাও তাহলে তোমার সেভাবে জায়গা নির্বাচন না করলেও চলবে। কিন্তু তোমাকে অবশ্যই ভাবতে হবে ব্যবসাটি কোথায় করলে ভাল হয় স্কুলের সামনে ,নাকি কলেজের সামনে, নাকি ইউনিভার্সিটির সামনে, নাকি এমন জায়গায় যেখানে বই বিক্রির ব্যবসা আগে থেকেই রয়েছে। কারণ মানুষের যখন কোন কিছু কেনার প্রয়োজন হয় তখন তারা বেশির ভাগ সময় মার্কেটপ্লেসই বেছে নেয়। সেখানে তাঁরা বিভিন্ন দোকান দেখে তার পছন্দমতো দোকান থেকে তার প্রয়োজনীয় বইটি কিনে থাকে। বইপ্রেমীদের ভীর এমন জায়গায় একটু বেশিই হয়।
দোকানের আয়তন কেমন হওয়া উচিত?
দোকানের আয়তন নির্ভর করবে তোমার পুঁজির উপর। অর্থাৎ ব্যবসার উপর তোমার বিনিয়োগ যত হবে তোমার দোকানের আয়তন ও তেমন হবে। সুতরাং তোমার পুঁজি বেশি হলে তোমার দোকানের আয়তন বড় করতে হবে আর যদি পুঁজি কম হয় তাহলে তোমার দোকানের আয়তন ছোট করতে হবে।
এছাড়া, তুমি যদি অনলাইনে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বই বিক্রি করতে চাও তবে একটি ভালো মানের বই এর ওয়েবসাইট তৈরী করলেই হয়ে গেলো। তার জন্য কোন নির্দিষ্ট লোকেশনের প্রয়োজন নেই।
ডেকারেশন কেমন হতে হবে?
ব্যবসার ক্ষেত্রে ডেকারেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তুমি তোমার ব্যবসা কিভাবে পরিচালনা করবে তা কিছুটা তোমার ডেকোরেশন এর উপর নির্ভর করবে। তোমার দোকানের যদি দুই পাশে সেল্ফ রাখার মত জায়গা থাকে সেক্ষেত্রে তুমি সেল্ফ দুইপাশে ব্যবহার করতে পারো আর যদি দোকানের তিন পাস সেল্ফ রাখার মত জায়গা থাকে তাহলে তুমি সেখানে তিনটি সেল্ফ বই রাখার জন্য রাখতে পারো। সেল্ফ গুলো হবে অবশ্যই বহু তাক বিশিষ্ট। এছাড়া তুমি দেওয়ালের সাথে এটাস্ট করেও সেল্ফ বানাতে পারো। ডেকোরেশন এর জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল দোকানের নির্দিষ্ট একটি নামের সাইনবোর্ড যা দোকানটিকে সকলের কাছে পরিচিত করতে সহায়তা করবে।
শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকার আছে কিনা?
এ ব্যবসাটি করতে শিক্ষাগত যোগ্যতার কিছুটা দরকার হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলে এ ব্যবসা করে সফল ব্যবসায়িক হতে পারবে না। এছাড়া সকল ব্যবসা এর ক্ষেত্রে দরকার ভালো আচার আচরণ,সততা ও ধৈর্য। যা ক্রেতাদের সাথে বিক্রেতাদের ভালো সম্পর্কের কারন হবে। আর সকল ব্যবসায়ীইকরাই তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য কিছু টেকনিক অবলম্বন করে থাকে। তবে তার সবগুলো হতে হবে সততার ভিত্তি স্বরূপ। আর বর্তমানে শিক্ষিত ব্যক্তিগণও এই বই বিক্রির পেশাকে তাদের জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। অনেকে আবার চাকরী থেকে অবশর নিয়েও বই এর দোকান খুলে বসেন।
কোথায় থেকে বই নিলে ভালো হয়?
কমবেশি সব ধরনের বই কেনার কেনার জন্য উপযুক্ত স্থান হল কলকাতার নতুন বাজার ও পুরান বাজার। সেখানে তুমি পুরাতন বই, নতুন বই, দেশি, বিদেশি সকল ধরনের বই পাবে। প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে রাস্তার ডান পাশে রয়েছে কলকাতার পুরাতন বই বাজার। সেখানে অসংখ্য বইয়ের দোকান রয়েছে। নার্সারি থেকে পিএইচডি ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ডাক্তার ইংলিশ থেকে বাংলা ইত্যাদি সমস্ত রকমের বই এখানে পাবে। কমপ্লিটিভ এক্সামের বই যেমন ইউপিএসসি ,ডব্লিউবিসিএস ,ক্যাট, ম্যাট ইত্যাদি সমস্ত রকমের বই সেখানে পাবে। সাধারণত ব্যবসার জিন্য ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ ডিসকাউন্টে এখান থেকে তুমি বই নিতে পারবে।
অন্যদিকে, নতুনবাজারে তুমি ভারত– বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বই পাবে। গল্প, উপন্যাস, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের বই পাবে। সেখানে তুমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বই পাবে। এখান থেকে নতুন বই নিলে পাইকারি মূল্যে ৪০ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্টে তোমার ব্যবসার জন্য বই নিতে পারো।
তুমি যদি কমপ্লিটেড এক্সাম এর বই নিয়ে ব্যবসা করতে চাও তাহলে এই ব্যবসাটি অনেক লাভজনক হবে। আবার এখান থেকে বিভিন্ন বাৎসরিক নোট বই, টেক্সট বই ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে যদি বিক্রি করতে না পারো তাহলে ওগুলো আবার ফেরত দেওয়া যায়। সুতরাং তুমি যদি বইয়ের ব্যবসা করতে চাও তাহলে সেখানে গিয়ে মার্কেট ঘুরে দাম দর করে বই নিতে পারো।
সম্ভাব্য পুঁজিঃ
ব্যবসার ক্ষেত্রে পুঁজি একটু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কারণ যেকোনো ব্যবসা শুরু করতে হলে দরকার হয় পুঁজি। তুমি যদি মনে করো ব্যবসাটি ছোট করে শুরু করবে তবে একরকম পুঁজি আবার ব্যবসাটি বড় করে শুরু করতে চাইলে আরেক রকম পুঁজি লাগবে। তোমার কাছে যদি ১ লক্ষ রুপি থাকে তাহলে তুমি তা দিয়ে ব্যবসাটি শুরু করতে পারো আবার তোমার কাছে যদি পাঁচ লক্ষ রুপি থাকে তাহলে তুমি তা দিয়েও ব্যবসা শুরু করতে পারো। সেক্ষেত্রে তোমার ব্যবসাটি নির্ভর করবে তোমার ইনভেস্টমেন্ট এর ওপর।
তোমার নিজস্ব দোকানের জায়গা থাকলে তোমার জন্য সেটা প্লাস পয়েন্ট। দোকান ভাড়া করতে হলে শহর, ছোট শহর এবং গ্রাম্ ভেদে তোমাকে ভাড়ার টাকা আলাদা করে গুনতে হবে।
প্রাথমিক প্রচার–প্রচারণা ও ক্রেতা সংগ্রহঃ
সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে তোমার ব্যবসা শুরু করতে পারো আর সেইসঙ্গে কয়েক মাস পর্যন্ত ক্রেতাদের বিশেষ সুবিধা দিতে পারো এতে করে ক্রেতারা তোমার দোকানের উপর আকৃষ্ট হবে এবং তোমার প্রচারণাও হয়ে যাবে। তোমার দোকানে কি বই রাখছো সে সম্পর্কে তোমার সাম্যক জ্ঞান ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে যথেষ্ঠ সহয়তা করে থাকে।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তোমার ব্যবসার নামে একটা আইডি বা পেজ খুলে সেখানে বিজ্ঞাপন প্রচার করে দোকানের প্রচার প্রচারণা করতে পারো।
কর্মী সংগ্রহের দরকার আছে কিনা?
তোমার দোকানে কর্মীর দরকার আছে কিনা তা নির্ভর করবে তোমার দোকানের সাইজের উপর। এছাড়া বর্তমানে প্রত্যেক দোকানে একজন বা দুইজন করে কর্মচারী থেকেই থাকে। অর্থাৎ তোমার দোকান যদি বড় আকারের হয় তাহলে তোমার দোকানের কর্মচারী নিয়োগ করতেই হবে আর যদি তোমার দোকান ছোট আকারের হয় তাহলে তুমি নিজেই এই ব্যবসাটি পরিচালনা করতে পারো।
কেমন আয় হয়?
বই বিক্রি করে কেমন আয় হতে পারে এতক্ষনে সেই ধারণাটা তুমি পেয়েই গেছো। যাইহোক, তোমার সততা নিষ্ঠা বজায় রেখে বই বিক্রির জন্য কিছুটা কৌশল অবলম্বন করে তুমি বই ভেদে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত আয় করতে পারো।
এভাবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে যাচাই–বাছাই করে তুমি তোমার ব্যবসাটি শুরু করতে পারো। এ ব্যবসার হরেক রকমের বইয়ের যেমন চাহিদা রয়েছে তেমনি লাভজনকও। মনে রাখতে হবে এই ব্যবসার প্রথম প্রথম ক্রেতা টানতে অনেক পন্থা অবলম্বন করতে হবে তার সবগুলো হতে হবে সততার ভিত্তিস্বরূপ। এসব বিষয়গুলো পরিস্কারভাবে জেনে তুমি যদি তোমার ব্যবসা শুরু করতে পারো তাহলে একজন সফল বই ব্যবসায়ী হতে পারবে।