স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবসা শুরু করবেন কিভাবে?
ভারতীয় সমাজে যত রকম কূ প্রথা প্রচলিত আছে তার মধ্যে রজঃস্বলা নারীর প্রতি নির্দেশিত অভ্যাসগুলি অন্যতম। যদিও আমরা সামাজিক জীবন যাপনের বিষয়ে এক বৈপ্লবিক আন্দোলনের খুব কাছে আছি গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে, তাও বিরাট জনসংখ্যার মহিলারা আজও মাসের ৫টা দিন কাটান অস্পৃশ্য হয়ে। শুধু তাই নয় অস্বাস্থকর অভ্যাসের ফলে অনেক মহিলা ভোগেন গোপন ও বেদনাদায়ক নানাবিধ অসুখে। ছবিটা আধুনিক নাগরিক জীবনে একটু উন্নত। তাও এখনো মেনস্ট্রুয়েশন বা স্ত্রীরজ নিয়ে আছে এক অকারণ লজ্জা ও গোপনীয়তা। যা আসলে স্নোবল এফেক্ট হয়ে গ্রামীণ সমাজে রূপান্তরিত হচ্ছে বিভিন্ন অত্যাচার ও অবিচারের রূপ নিয়ে।
বিগত প্রায় তিন দশক ধরে ভারত সরকার চেষ্টা করেছে এই ছবিটা পাল্টাতে। ঋতুস্রাব ঘিরে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস কাটিয়ে, বিশেষ রূপে গ্রামীণ মহিলাদের জন্য সহজলভ্য করতে স্যানিটারি ন্যাপকিন। যাতে তারাও একটি স্বাস্থকর জীবনযাত্রা পেতে পারেন। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন এগিয়ে এসেছে, গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষদের শিক্ষিত ও সচেতন করতে মেন্সট্রুয়াল হাইজিন সম্বন্ধে। আর এই প্রসঙ্গে সবার আগে আসে স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাডের কথা।
স্যানিটারি ন্যাপকিন কি?
এটি একরকম বিশোষক পদার্থ যা দুটি কৃত্রিম ভাবে তৈরী কাপড়ের মধ্যে অবস্থিত থেকে নিষ্কৃত রক্ত শুষে নিয়ে শুকনো রাখে নারী শরীর।
স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবসার প্রয়োজন কি?
- গ্রামীণ নারী ও যুবতী মেয়েদেরকে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যাপারে শিক্ষিত করা।
- মাসিক জনিত অসুখ প্রতিরোধ ও স্বাস্থসম্মত জীবনযাত্রা প্রচলন করা।
- কম মূল্যে উচ্চমানের স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রস্তুত করা।
- গ্রামীণ চাকরিহীন যুবকদের মার্কেটিং ও উৎপাদনের কাজে নিয়োগ করে চাকরি সৃষ্টি করা।
- উন্নত গুণমানের স্যানিটারি ন্যাপকিনকে সহজলভ্য করে তোলা।
পণ্য বাজারে এটি একটি অপরিহার্য সামগ্রী ও এর একটি বিরাট চাহিদা ও যোগানের বাজার আছে। কিন্তু বাজারে উপলব্ধ অধিকাংশ স্যানিটারি ন্যাপকিন অতি উন্নত মানের মেশিনে অতি দ্রুত উৎপাদন হয় আর তাই তাদের মূল্য হয় অনেক চড়া, যা কিনা দারিদ্র সীমার নিচের বা গ্রামীণ মহিলাদের আয়ত্তের বাইরে।
বিপুল সংখ্যায় উৎপাদনকারী মেশিন কেনা অত্যন্ত ব্যায় সাধ্য আর নতুন উদ্যোক্তার জন্য পরামর্শনীও নয়। ভারতবর্ষে তৈরী আধা স্বয়ংক্রিয় অনেক মেশিন উপলব্ধ আছে বাজারে যার খরচ ৫ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু ধীর গতি ও সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় না হওয়ার জন্য উৎপাদনের খরচ অত্যন্ত বেড়ে যায় আর ন্যাপকিনের গুণগত মানও খারাপ হয়।
উৎপাদনের খরচ কম রেখে গুণগত মান উন্নত করার জন্য যে মেশিনের প্রয়োজন, আদর্শ ভাবে তাদের উৎপাদন গতি হওয়া উচিত ৫ থেকে ৩০ ন্যাপকিন প্রতি মিনিটে। এই ধরণের মেশিনের দাম ৮.৫ লক্ষ থেকে ৩৫ লক্ষের মধ্যে হয়। গতির দিক থেকে এরা মধ্যবর্গীও।
ব্যবসার শুরু করার পদ্ধতি
বিনিয়োগ জোগাড় করার জন্য বিভিন্ন সরকারি ঋণ প্রকল্প আছে, যার সাহায্যে ১০ লক্ষ থেকে ১ কোটি অর্থ সাহায্য পাওয়া যায়। তাছাড়াও গ্রামীণ অধিবাসী, তফসিলি জাতিভুক্ত ও নারী হলে এই ঋণের ওপরেও অনেক ছাড় পাওয়া যায়। সর্বাধিক ৬ মাস লাগে ঋণ পেতে।
স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদন করতে এফ ডি এর অনুমতি লাগে না , কিন্তু বি আই এসের অনুমতি প্রয়োজন। যার জন্য প্যাডের কাঁচা মাল ও উৎপাদন স্থলের পরিবেশ হতে হবে যথাযত। ন্যাপকিন তৈরী হয়ে গেলে যেকোনো এন এ বি এল রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠাতে হবে, আপনার ন্যাপকিনকে বি আই এসের মানদন্ডে যাচাই করার জন্য। বি আই এসের কমপ্লায়েন্স এর ছাড়পত্র পেয়ে গেলে আপনি পরবর্তী ধাপে এগিয়ে যাবেন।
বিদ্যুৎ, আগুন সংক্রান্ত বিধি নিষেধ মেনে, শপ এন্ড এস্টাব্লিশমেন্ট লাইসেন্স নিয়ে, নির্দিষ্ট রাজ্য সরকারের আওতায় আরো বিভিন্ন ছাড়পত্র জোগাড় করতে হবে।
আপনার মিডস্কেল মেশিনের ওপর নির্ভর করে ১০০০ থেকে ৩০০০ স্কয়ার ফুট জমি প্রয়োজন হবে আপনার। উৎপাদনের থেকে বেশি পরিষ্কার, শুকনো গুদামজাত করার জায়গা দরকার পড়বে ন্যাপকিনের উৎপাদন সামগ্রীর জন্য।
এয়ার কম্প্রেসার, এয়ার ড্রায়ার, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার, ইনভার্টার ইত্যাদি মেশিনের প্রয়োজন হতে পারে।
কাঁচা মাল জোগাড় করতে হবে উৎপাদনের জন্য।
সাধারণত এয়ার লেড কাগজ, অথবা উড পাল্প, স্যাপ যুক্ত টিসু, পি ই ফিল্মস, আঠা, রিলিস কাগজ ইত্যাদি উপাদান লাগে। কিন্তু আজকাল প্রাকৃতিক বস্তুর চাহিদা তৈরী হয়েছে।
আপনাকে এবার আপনার পণ্য বাজারে বিতরণ করতে হবে। সবার আগে একটি ব্র্যান্ড তৈরী করুন। নাম নথিভুক্ত করুন। কর প্রভৃতি ঠিক ঠাক দাখিল করুন। বি আই এসের জন্য প্যাকেজিংয়ের প্রতিও যথেষ্ট নজর দিতে হবে আপনাকে। ট্রেডমার্ক দিয়ে আপনার ব্র্যান্ড টিকে সুরক্ষিত করতে ভুলবেন না।
আপনার মার্কেটিং দক্ষতায় আপনি স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলি বাকিদের থেকে আলাদা করে ফেলুন। শহরে আর গ্রামে বিভিন্ন উপায় প্রচার করুন আপনার পণ্যের।
আপনার পণ্যের সম্ভাব্য ক্রেতা করা হতে পারে সেটি চিহ্নিত করুন। তাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করুন। শহরে ওষুধের দোকান, টিভি, কাগজে বিজ্ঞাপন, আর গ্রামে এন জি ও, স্বাস্থকর্মী, মহিলা সমিতি ইত্যাদি সংগঠনের সাহায্য নিন কারণ এইসব জায়গায় দোকান পাবেন না আপনার পণ্য সরবরাহ করার জন্য।
জরুরি পণ্য ও চিরন্তন চাহিদার জন্য এই ব্যবসায় যথেষ্ট প্রতিযোগিতা পাবেন। শুধুমাত্র আপনার প্রচার ও পরিচিতি পারবে আপনার ব্যবসাকে দাঁড় করাতে। মনে রাখতে হবে, একবার ব্যবসা জমে গেলে, সারা বছর যোগান ও গুনগত মান নিয়ন্ত্রণ ও চালু রাখতেই হবে নইলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন।
প্যাডম্যান চলচিত্র স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিষয়ে অনেককেই শিক্ষিত করেছে। আর বাকিদের জড়তা কাটাতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এই চলচিত্র মুক্তি পাবার অনেক আগে থেকেই সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টায় সমাজের আর্থিক দিকে নিম্ন স্তরের ও গ্রামীণ মানুষদের জাগরুক করার চেষ্টা চলছিল। তার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক স্যানিটারি ন্যাপকিনের সংগঠনগুলির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শহুরে যুবতীরা কাটিয়ে উঠছিলো লজ্জার বেড়া জাল এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ঘিরে। মধ্যবিত্তর আর্থিক অগ্রগতি, সামাজিক সচেতনতা আর তার সাথে বাণিজ্যিক বিনোদন এক হয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবসাকে করে তুলেছে বাজারে লাভজনক ব্যবসাগুলির মধ্যে অন্যতম।
এই ব্যবসার মূল লক্ষ্য হলো ন্যুনতম খরচে কিভাবে দ্রুততম গতিতে সর্বাধিক পাতলা অথচ সক্ষম স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরী করা যাবে। যদিও যেকোনো নবীন উদ্যোক্তার পক্ষে এই সবকটি চাহিদা মিটিয়ে আলোচ্য পণ্যটি প্রস্তুত করে লাভের মুখ দেখতে পারা অলীক কল্পনা। তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপোষ করে মোটামুটি ভালো গুণমানের স্যানিটারি ন্যাপকিন বাজারে এনে যদি গ্রামীণ ও দরিদ্র মহিলাদের মধ্যে তা সহজলভ্য করা যায় আর তা থেকে উদ্যোক্তার কিছু উপার্জন লাভ হয়, তাহলে এর থেকে ভালো ব্যবসা আর কিইবা হতে পারে?
প্যাড মানের নায়কের চরিত্র যার ওপর ভিত্তিক সেই অরুণাচালাম মুরুগানাথম এই কাজটিই করে দেখিয়েছেন। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে বড় হয়ে যিনি এখন উদ্যোগপতি ও সমাজ সংস্কারক। অতি অল্প মূল্যে উত্তম গুনের স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরী করে তিনি চুপিসারে এক গণ আন্দোলন এনেছেন দেশে। তার লড়াই শুধুমাত্র স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রির জন্য নয় বরং সমাজের কুপ্রথার শিকার হওয়া নারীদের স্বাস্থসম্মত জীবনের অধিকার প্রদানের এক প্রবল প্রচেষ্টা।
শেষে যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো বর্তমানে দামি স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলোর অধিকাংশ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরী নয়। এগুলি প্লাষ্টিক ওয়েস্ট হয়ে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভার সাম্য নষ্ট করতে পারে কারণ বিজ্ঞান বলছে সর্ব প্রথম তৈরী হওয়া স্যানিটারি ন্যাপকিন টি এখনো বিনষ্ট হয়নি। তাই যুবতীদের মধ্যে এখন একটি সচেতন মনোভাব কাজ করছে যার ফলে তারা ঝুঁকছে কাপড়ের ন্যাপকিন বা স্যানিটারি কাপের মতো বিকল্পের দিকে।