ভারতের পরিষেবা ক্ষেত্রের উদ্যোগ সংস্থারগুলির সামনের প্রতিকূলতা
অর্থনীতিকে যদি তিনটি ক্ষেত্র বিশেষে ভাগ করা যায়, তাহলে আমরা দেখবো প্রথম ভাগে কৃষি, চাষ ও খনন থাকে, দ্বিতীয় সারিতে থাকে উৎপাদন ও তৃতীয় সারিতে পরিষেবা টারশিয়ারি বা তৃতীয় ক্ষেত্র ।
প্রথম দুটি সারিতে কাঁচা মাল তৈরী ও তা থেকে অন্য দ্রব্য উৎপাদন হয়। কিন্তু তৃতীয় সারির কার্যক্রম হয়ে অনুভূতির বা পরিষেবার। আর অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী কৃষি ভিত্তিক বা শিল্প–বাণিজ্য ভিত্তিক দেশ নয়, পরিষেবা ভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজের দেশই অগ্রগামী হয়ে বিশ্বের দরবারে ।
আসুন দেখে নেয়া যাক পরিষেবা শিল্প ক্ষেত্রের আওতায় কি ধরণের শিল্প সমূহকে ধরা হয়
- শিক্ষা
- স্বাস্থ্য
- ভ্রমণ
- তথ্য প্রযুক্তি
- হোটেল বা আতিথেয়তা
- পরিবহন
- সংরক্ষণ
- অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনা বা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি
অর্থাৎ এমন যেকোনো ক্ষেত্র যেখানে দ্রব্য নয় সেবা কেনা বেচা হয়।
সি আই এ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক বলছে ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারত, পরিষেবা উৎপাদনে বিশ্বে ৮ নম্বর স্থানে। প্রথমে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় স্থানে চীন।
সহজেই অনুমেয় যে তৃতীয় সারির ক্ষেত্র হলেও পরিষেবা ক্ষেত্রই হলো বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদন্ড। আর তাই বলাই বাহুল্য যে পরিসেবা ক্ষেত্রের বিকাশ হলে সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ সম্ভব। আর তাই সরকার পরিষেবা শিল্পের ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগী হবে এবং বিশেষ সহায়তা করবে শিল্পপতিদের এটাই কাম্য। বিশেষ করে উদ্দ্যোগপতিদের কাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরী করা একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দাবি অর্থনীতির।
কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি কি তাই?
- নতুন শিল্প উদ্যোগে প্রাথমিক খরচ আকাশ চুম্বি। স্থানীয় সরকারি সাহায্য না পেলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা এক অমানুষিক কাজ। সরকারি নিয়মাবলী মেনে ১২ টি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে প্রায় এক মাস লেগে যায়।
- নির্মাণের অনুমতি প্রাপ্তিও এক বিরাট খরচ সাধ্য ব্যাপার। ৩৪ টি আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করতে লেগে যায় ১৯৬ দিন।
- বৈদ্যুতিক সংযোগ পাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে কম খরচের হলেও, প্রয়োজনীয় কাজকর্ম মেটানো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। পর্যবেক্ষণ, মিটার বসানো ও সংযোগ পেতে লেগে যায় এক মাসের একটু বেশি।
- সম্পত্তি নথিভুক্ত করানো এক শারিরীক শ্রম সাধ্য কাজ। অনেক দৌড় দৌড়ি করে এই কাজ সম্পূর্ণ করতে হয় আর এর সাথে স্ট্যাম্প ডিউটি, কর, এটর্নির বেতন ইত্যাদি তো আছেই।
- স্থানীয় অনুদান পাওয়া খুবই সহজ।
- লগ্নিকারীদের সাথে চুক্তি ও লগ্নিকারীর স্বার্থ রক্ষার জন্য নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করতে লেগে যায় চার পাঁচ বছর।
- ভারতে ক্রিয়াশীল শিল্পপতিদের বছরে ৩৩ টি কর প্রদান করতে হয় যা করতে খরচ হয় ২৪৩ ঘন্টা।
- ভারতে আন্তর্জাতিক ব্যবসার পথ আগের থেকে সুগম হলেও এখনো যথেষ্ট লাল ফিতের কড়াকড়ি দেখা যায় যা আমদানি রফতানি করতে খুবই বাধার সৃষ্টি করে।
- কোনো সংস্থা দেউলিয়া ঘোষণা করলে তা নিয়ে আদালতের কাজ শেষ হতে হতে ৪ বছরের বেশি সময় লেগে যায়
- বিভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধনের দেশে বিদেশী আগুন্তুকের পক্ষে মানিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে যায়।
শুধুমাত্র পরিষেবা শিল্প সংক্রান্ত সমস্যা:
- আদর্শ পরিকাঠামোর অভাব সবথেকে বেশি সমস্যায় ফেলে পরিষেবা শিল্প ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের। যথেষ্ট ভালো পরিবেশ ও সাজসরঞ্জামের অভাবে আমাদের হাসপাতালগুলো পাল্লা দিতে পারেনা আন্তর্জাতিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে বা পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাবে পিছিয়ে পড়ে আমাদের বিদ্যালয়গুলি।
- একটি বড় সমস্যা হলো পরিষেবা শিল্প ক্ষেত্রটি সুসংহত নয়। তাই শ্রম বিধি, কাজের গুণগত মান, প্রভৃতি বিষয় মাপার কোনো সঠিক মানদণ্ড নেই।
- কিন্তু সবথেকে বড় কারণ যা ভারতীয় পরিষেবা উদ্যোগপতিদের পিছিয়ে দিচ্ছে অর্থনীতির বাজারে তা হলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে আসছে প্রচন্ড কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
আন্তর্জাতিক বা বাইরের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল হলে আমরা বিদেশী শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবো আবার তাই আমাদের সময়ের দাবি আমাদের দেশের ভেতরে পরিষেবা সংক্রান্ত চাহিদা জন্মাক।
আর একটি বাস্তব সমস্যা হলো পরিষেবা ক্ষেত্র সব সময় চায় সর্বনিম্ন লোকবলে যতটা বেশি সেবা উৎপাদন করা যায়। তার ফলে স্কীলড লেবারের প্রয়োজন পড়ে কিন্তু আমাদের দেশে এই চাহিদার যোগান ভালো পাওয়া যায়না। কারণ বেশিরভাগ প্রতিভা বিদেশে কাজ করতে চায়। আর আমাদের কাছে পড়ে থাকে একটি বিশাল সংখ্যার অনস্কিল্ড লেবার যা পরিষেবা শিল্পের পক্ষে লাভজনক হয়না।
বর্তমানে উৎপাদন শিল্পকে জোরদার করার একটি প্রচেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু শক্তিশালী পরিষেবা ক্ষেত্র ছাড়া উৎপাদন ক্ষেত্রকে শক্তিশালী করা অসম্ভব।
জিএসটি এর প্রভাব পরিষেবা ক্ষেত্রে:
ভালো:
- বার বার কর দান থেকে মুক্তি
- সফ্টওয়ার শিল্পে দ্রব্য ও পরিষেবার সংজ্ঞা নির্ধারণের ফলে আসলো আরো স্বচ্ছতা
- মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষেত্রে আরো ছাড় পাওয়া যাবে
- ভ্যাট ও এক্সাইস ডিউটির অবসান
- বিনিয়োগের খরচ কমবে
- সব রাজ্যে এক নিয়ম প্রচলন হবে
খারাপ:
- কেন্দ্রীয় নথিভুক্তিকরণের অভাব
- বিনিমূল্য পরিষেবার ওপরেও দিতে হবে কর
- উপভোক্তার ওপর পড়বে অধিক করের ভার
- বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে রাখতে হবে স্বতন্ত্র হিসেব
- কর দাখিল করার প্রক্রিয়া জটিল হয়েছে
- সব স্তরের মানুষকে জি এস টির সুবিধে বোঝানো প্রয়োজন যা কষ্টসাধ্য
স্কিলড লেবার যারা তাদের ইচ্ছে থাকে পরিষেবা শিল্প ক্ষেত্র তে যোগ দেয়ার কিন্তু চাকরির পদ বেশি থাকে না তাই ভালো ছাত্ররা পাড়ি জমায় বিদেশে আর তার ফলে যে স্বল্প সংখক চাকরির পদ তৈরী হয়ে আমাদের দেশে পরিষেবা ক্ষেত্রে তাও শুন্য থাকে। উদ্যোগপতিরা উপায় না দেখে সেই সব পদে নিয়ে নেয় অনস্কিল্ড লেবারদের। এর ফলাফল দাঁড়ায় নিম্ন মানের পরিষেবায়।
অবশেষে এটাই বলা যায় যে আমাদের দেশকে বিশ্ব দরবারে নিজের আসন কায়েম করতে হলে অতি অবশ্যই পরিষেবা শিল্পকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। আর তার জন্য উন্নততর পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। প্রতিভাদের রাখতে হবে এই দেশেই। কর ব্যাবস্থাকে আরো সরল করতে হবে। আনুষ্ঠানিকতাকে কে আরো সংক্ষিপ্ত করতে হবে। স্থানীয় সরকারি আমলাদের আরো বেশি করে সহযোগিতা করতে হবে উদ্যোগপতিদের সাথে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ আরো সুগম করতে হবে। বিভিন্ন রাজ্য গুলিকে একে ওপরের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে একসাথে পরিষেবা শিল্প ক্ষেত্রে উদ্যোগপতিদের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।
কিন্তু সবথেকে প্রধান যে শর্তটি পরিষেবা শিল্পের জন্য প্রযোজ্য তা হলো জনসাধারণকে জাগরিত হতে হবে। দেশের পরিষেবা নেয়ার কথা ভাবতে হবে। দেশের পরিষেবার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
যুব সম্প্রদায়কে শিল্পমুখী হতে হবে। উদ্যোগক্তা হতে অনুপ্রাণিত করতে হবে আমাদের সমাজের তরুণদের। তাহলেই তৈরী হবে নতুন নতুন উপার্জনের রাস্তা। সবার সাথে সবার যদি সহযোগিতা থাকে তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বন্ধু ভেবে একে ওপরের ব্যবসাকে প্রচার করতে পারবে তরুণ সম্প্রদায়।
একে ওপরের সাথে ভালো ব্যবহার করে বাড়াতে হবে বন্ধুত্ব। যে ডেলিভারি বয়টি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল, যে ক্যাব ড্রাইভার ৫ মিনিট দেরি করে ফেলেছিলো তার প্রতি সহানুভূতি রাখতে হবে। আর পরিষেবা শিল্পের কর্মীদের করে তুলতে হবে মানব দরদী। শেখাতে হবে জনসংযোগ। মানুষের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, কি করে রাগী খদ্দেরকে মানাতে হয়, শেখাতে হবে এসবকিছু হাতে ধরে।
করোনা যেমন কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু তেমনি অনেক কিছু শিখিয়েও দিয়েছে আমাদের। তার মধ্যে একটি হলো স্থানীয় পরিষেবা কিভাবে ছাপিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পরিষেবাকে। এই মোমেন্টামটা ধরে রাখতে হবে। ক্রেতার প্রত্যাশা পূরণ নয় শুধু প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গিয়ে তাকে বাকরুদ্ধ করে দিতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে পরিষেবা শিল্প ক্ষেত্রের এই প্রতিকূলতাগুলি কাটিয়ে তোলা খুব একটা কঠিন হবে না। আর আমাদের দেশ যেভাবে অগ্রগতি করছে তাতে সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় সেদিন বেশি দূরে নেই।