লিপ বাম উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবসা শুরু করবেন কিভাবে
ত্বকের যত্ন নিন। কি? মনে পড়ে গেলো তো নারীদের ত্বকচর্চা নিয়ে কৌতুক ভরা কথাগুলি? কৌতুক, বিদ্রুপ সবকিছু অগ্রাহ্য করে স্কিনকেয়ার বা ত্বকচর্চা কিন্তু হয়ে উঠেছে একটি প্রবল শক্তিশালী বাণিজ্য। যে নারীরা প্রসাধন বা মেকাপ চর্চা করেন না তারাও কিন্তু ত্বকের প্রতি যত্নশীল। আর শুধু নারী কেন এখন পুরুষরাও যথেষ্ট যত্নবান তাদের ব্যক্তিগত উপস্থিতির সম্পর্কে। তাই ঠোঁটের যত্ন এমন একটি বিষয় যাকে ভিত্তি করে গড়ে তুলতেই পারেন আপনি একটি বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য। কারণ সারা বছর ফাটা ঠোঁট থেকে মুক্তির জন্য অধিকাংশ মানুষই ব্যবহার করেন লিপ বাম। তাই লিপস্টিকের থেকেও লিপ বামের চাহিদা বেশি। শুধু তাই নয়; লিপ বাম বাড়িতে বানানো অত্যন্ত সহজ। উৎপাদন করতে বিনিয়োগ নামমাত্র করতে হয়। তাই নবীন উদ্যোগপতিরা যারা সবসময় নতুন নতুন ব্যবসার রাস্তা খুঁজে বার করতে চান তারা বাড়িতে লিপ বাম উৎপাদন ও সরবরাহের দিকে ক্রমশ আকৃষ্ট হচ্ছেন।
প্রাকৃতিক লিপ কেয়ার পণ্যের কদর কিরকম?
সমীক্ষা বলছে, প্রাকৃতিক লিপ কেয়ার পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ২০১৫এ একটি ইন্ডাস্ট্রি আউটলুকের বিবৃতি অনুযায়ী, ৪২ শতাংশের কাছাকাছি, ১৮ বছরের বেশি মেয়েরা পছন্দ করছে প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরী ত্বক চর্চার সামগ্রী, সিনথেটিক বা প্রক্রিয়াজাত সামগ্রী নয়। গুগল ট্রেন্ডও এই কথা সমর্থন করছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরী লিপ কেয়ার পণ্য সংস্থা গুলি বিপুল লাভ অর্জন করছে সারা পৃথিবীতে। তাহলে সহজেই অনুমেয় বাড়িতে অল্প খরচে, প্রাকৃতিক উপাদানে লিপ বাম তৈরী করে উদ্যোগপতিরা হতে পারেন এই লাভের ভাগিদার।
এবার দেখেনি প্রধান প্রকার লিপ বাম গুলি কি কি
বিস্ওয়াক্স:
প্রাকৃতিক লিপ বাম তৈরী করতে গেলে মধু বা বিস্ওয়াক্স সর্ব প্রথম উপাদান যা আপনার বামের বেস বা আধার বানাবে। বিস্ওয়াক্স জোগাড় করা খুবই সহজ, এটি দামেও সস্তা আর খুব ভালো ভাবে মিশেও যায় অন্যান্য উপকরণের সাথে।
টিন্টেড বা রং যুক্ত:
প্রাকৃতিক লিপ বামের কাজ ঠোঁট ফাটা থেকে রক্ষা ও ঠোঁটকে কোমল রাখার। কিন্তু অনেক উপভোক্তা আছেন যারা এর সাথে সাথে চট করে ঠোঁট একটু রাঙিয়ে নিতেও পছন্দ করেন। তাদের জন্য আছে টিন্টেড লিপ বাম। গোলাপি, লাল, কমলা, বেগুনি, যেকোনো রঙে বানাতে পারেন টিন্টেড লিপ বাম, মূল মিশ্রনের সাথে আপনার পছন্দের রঙের একটু লিপস্টিক বা মাইকা পাউডার মিশিয়ে।
ওষুধ যুক্ত বা মেডিকেটেড:
ফাটা ঠোঁটের ব্যাথা থেকে আরাম দিতে, অনেক প্রাকৃতিক লিপ বামে থাকে কর্পূর বা মেনথলের মতো সামগ্রিক উপাদান। আপনি চাইলে এসেনশিয়াল অয়েলও ব্যবহার করতে পারেন। এক একটি তেলের এক এক রকম গুন থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, ল্যাভেন্ডার মানসিক উত্তেজনা প্রশমন করে মনকে শান্ত করে।
উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও উৎপাদন পদ্ধতি কি?
- একটি পাইরেক্স কন্টেনার বা তাপ সহ্য করার মতো বোরোসিলিকেট কাঁচের পাত্র
- সসপ্যান
- কাঠের স্প্যাচুলা বা চপস্টিক, মিশ্রণ নাড়ানোর জন্য
- তৈরী হবার পর লিপ বাম কৌটোয় বা টিউবে স্থানান্তরিত করার জন্য ওষুধের ড্রপার বা পিপেট যা আপনি ওষুধের দোকানে পেয়ে যাবেন
- কৌটো বা টিউব যা আপনি অনলাইনে বাল্ক দরে জোগাড় করতে পারেন আবার স্থানীয় ব্যাপারীদের থেকে পাইকারি দরে কিনতে পারেন।
- বিস্ওয়াক্স
- কোকো বাটার বা মাখন
- অলিভ, জোজোবা বা নারকোল তেল
- রং (ঐচ্ছিক)
- ফ্লেভার (ঐচ্ছিক)
- সুগন্ধি (ঐচ্ছিক)
- এসেন্সিয়াল অয়েল (ঐচ্ছিক)
একটি সরল পদ্ধতি যার ওপর ভিত্তি করে আর চাইলে একটু অদল বদল করে বানাতে পারেন আপনার নিজস্ব প্রণালী:
আপনার প্রথম ব্যাচ যত বড় বা ছোট হোক না কেন, এই হিসেবে টি মনে রাখবেন:
২০ শতাংশ ওয়াক্স, ১০ শতাংশ কোকো মাখন, ২০ শতাংশ জমাট তেল বা যেকোনো মাখন আর ৫০ শতাংশ তরল তেল। এর সাথে ১ শতাংশ সুগন্ধি, স্বাদ বা এসেন্সিয়াল অয়েল যোগ করতে পারেন।
এবার দুই প্রকার মাখন আর মধু একসাথে গলিয়ে নিয়ে তাতে তরল তেল যোগ করুন। মিশ্রণটি ঠান্ডা করুন ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস অব্দি। তারপর বাকি উপাদানগুলি মিশিয়ে নিন আর পুরো টা আরো ঠান্ডা হতে দিন ৫ ডিগ্রি। তারপর ঢেলে ফেলুন কৌটো বা টিউবে।
সরবরাহ করবেন কি করে
লিপ বাম তৈরী হয়ে গেলে আপনার আসল কাজ শুরু। তা হলো আপনার ঘরে বানানো দ্রব্যটিকে বিক্রি করা। আপনি দুভাবে বিক্রি করতে পারেন আপনার লিপ বাম:
- ভার্চুয়ালি বা ইন্টারনেটে
- শারীরিকভাবে
ইন্টারনেটে
বিক্রি করা বেশি ভালো কারণ এতে সহজেই আপনি আপনার পরিষেবাটি ছড়িয়ে দিতে পারবেন দূর দূরান্তে। তাছাড়া আপনার ব্যবসার বার্তা প্রচার করে সবাইকে জানাতেও পারবেন সহজে।
অনলাইন উপস্থিতির জন্য প্রথমেই তৈরী করতে হবে আপনাকে একটি অনলাইন স্টোর। যেখানে সহজে ও নিরাপদে ক্রেতারা আপনার জিনিস দেখতে ও কিনতে পারবে।
অনলাইন স্টোরের পরেই আপনাকে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারস্থ হতে হবে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, পিন্টারেস্ট সহ ই কমার্স জায়ান্ট আমাজন প্রভৃতিতে রাখতে হবে বিজ্ঞাপন, ক্রয় ও সরবরাহের রাস্তা।
ইমেল মার্কেটিং পদ্ধতির সাহায্যে ক্রেতাকে ব্যক্তিগত ভাবে অবগত করুন আপনার পণ্য পরিষেবার বিষয়ে। আকর্ষণীয় ছাড় আর বিনামূল্যে প্রদান বা গিভাওয়ে প্রভৃতি আধুনিক মার্কেটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে গড়ে তুলুন ক্রেতার আনুগত্য।
বিভিন্ন বিস্বস্ত ডেলিভারি পরিষেবার সাথে ব্যবসাকে যুক্ত করুন।
সরাসরি বিক্রি
যদি করতে চান তাহলে বিভিন্ন পাইকারি বিক্রেতার সাথে কথা বলুন। শপিংমলে অস্থায়ী দোকান খুলতে পারেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা প্রতিযোগিতায় আপনার পণ্য কে পুরস্কার হিসেবে প্রদান করুন।
লিপ বাম বাণিজ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম নয়। তাই আপনাকে হতে হবে চিন্তাশীল ও সৃজনশীল আপনার পণ্যের বিষয়ে। নিচে কয়েকটি পরামর্শ দেয়া হলো:
- রং, গন্ধ, স্বাদ নিয়ে একটু পরীক্ষা নিরীক্ষা করুন। স্ট্রবেরি স্বাদের বাম বা গোলাপের রঙের বাম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কাজ করুন।
- বছরের বিভিন্ন সময়ের জন্য ভিন্ন প্রকারের উৎপাদন করুন। যথা, শীতকালে গাঢ় বাম বা গ্রীষ্মে হালকা এলোভেরার বাম।
- পুরুষ ও শিশু শ্রেণীর ক্রেতা গোষ্ঠীকে আকর্ষণ করুন মোড়ক, রঙে ও স্বাদে তারতম্য এনে।
- উৎপাদন সামগ্রী কেনার থেকে সরবরাহে খরচ হবে বেশি।
- ভালো ছবি বা চিত্রগ্রাহক আপনার পণ্যের জনপ্রিয়তা বাড়াবে।
- পণ্য বিবরণের ভাষার প্রতি যত্নবান হতে হবে। আপনার পণ্যের সামগ্রী, রং, স্বাদ, গন্ধের বিশদ বিবরণ সুচারু ভাষায় বিজ্ঞপ্তি দিন।
- সরবরাহের সময় পণ্যের মোড়ক সম্পর্কে খেয়াল রাখবেন, তা যেন যথেষ্ট মনোগ্রাহী হয়।
বিশেষ রূপে একটি কথা মনে রাখবেন, ব্যবসায়ে নামার আগে যেমন কর ও অনুমতিপত্রের খোঁজখবর করবেন ঠিক সেইভাবেই স্থানীয় স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষা আইন নিয়ে বিশদে জানার চেষ্টা করবেন। কারণ সরকারি বিধি মেনে উৎপাদন না করলে, তার পরিনাম খুবই বিপদজনক হবে।
আপনি এবার লিপ বাম উৎপাদন ও সরবরাহের প্রাথমিক সব তথ্যই পেয়ে গেছেন। এখন একটু সময় নিয়ে সব কটি আলোচিত বিষয়গুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ুন ও আরো গবেষণা করুন। দরকার মনে হলে, কথা বলুন কোনো রাসায়নিকের সাথে। প্রথমে ছোট একটি ব্যাচ উৎপাদন করুন, বাজার বুঝে ধীরে ধীরে বাড়ান আপনার পণ্য সংখ্যা। অনলাইন মার্কেটিং নিয়ে আরো জানুন; ইনফ্লুয়েন্সার কারা, তাদের কিভাবে কাজে লাগাবেন, ব্লগিং কি জিনিস ইত্যাদি। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনাকে আপনার পণ্যে অভিনবত্ব আনতে হবে। সেটা উৎপাদনেও হতে পারে আবার মার্কেটিংয়েও হতে পারে। কিন্তু যদি সৃষ্টিশীল হতে পারেন আর নিজে হাতে গড়ে তোলায় আনন্দ পান কোনো বস্তু, তাহলে স্বল্প বিনিয়োগের এই ব্যবসায় যথেষ্ট লাভবান হতে পারেন। ১০ জন মহিলার মধ্যে ৬ জন ব্যবহার করেন যে পণ্য, তার চাহিদা বাজারে কমবে না বরং উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাবে।