কী কী প্রয়োজন এবং টিফিন পরিসেবা ব্যবসা কীভাবে শুরু করবেন
ভারতের জোম্যাটো, স্যুইগির মতো মতো অ্যাপের কল্যাণে এখন ঘরে বা অফিসে বসেই প্রিয় রেস্টুরেন্টের প্রিয় খাবার ফরমায়েশ দিয়ে আনা যায়। বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে খাওয়ার এই নতুন প্রবণতার যুগে একই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে রেস্টুরেন্ট বা টিফিন ব্যবসার ধরনও। অনেক রেস্টুরেন্ট আছে যেগুলোর আছে শুধু রান্নাঘর আর স্টোররুম। স্টাফ বলতে শুধু রাঁধুনী ও তার সহযোগী। এসব জায়গায় বসে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। কারণ এসব রেস্টুরেন্টের অর্ডার আসে অনলাইনের মাধ্যমে। গ্রাহককে খাবার পৌঁছে দেয় ফুড অ্যাগ্রিগেটর বা ডেলিভারি ম্যানেরা। এর ফলে এখন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা হয়ে গেছে অনেকটাই সহজ ও ঝামেলামুক্ত। এতে করে প্রাথমিক পুঁজিও লাগছে অনেক কম। মূলত এ ধরনের রেস্টুরেন্টকেই টিফিন পরিসেবার আওতায় ধরা হচ্ছে। আজকাল ভারতে এ ব্যবসা খুব প্রসার পাচ্ছে। যারা এরকম একটা ব্যবসা শুরু করে আপনিও খুব সহজে নিজেকে সফল উদ্যক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন।
কেন এই ব্যবসা করবে?
যে কোনো ব্যবসাতেই প্রথম ও প্রধান বাধা হলো পুঁজি। খুব কম মানুষই বড় অংকের পুঁজি বিনিয়োগ করে ঝুঁকি নেয়ার সাহস করে। কিন্তু টিফিন ব্যবসায় খুব কম পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসা শুরু করা যায়। তুমি নিজে ভালো রান্না জানলে কাজটা তোমার জন্য আরো সহজ হবে। তোমার যেটা দরকার তা শুধু রান্নাঘরের জন্য উপযুক্ত জায়গা খোঁজা ও ভাড়া নেয়া। তোমার নিজের জায়গা থাকলে তো হয়েই গেলো। বসবাসের ফ্ল্যাটেও অনায়াসে ব্যবসাটি করা যায়, তবে সেক্ষেত্রে লাইসেন্স পাওয়া একটু কঠিন হতে পারে।
টিফিন পরিসেবা ব্যবসার আরো বড় সুবিধা হলো, সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট সাজানো, রক্ষণাবেক্ষণ এসবে প্রচুর খরচ হয়। তোমার এই ব্যবসায় খরচের পুরোটাই বেঁচে যাবে। তাছাড়া খাবার পরিবেশনের ঝামেলা নেই, সুতরাং কর্মী সংখ্যা অনেক কম হবে, ফলে বেতন–ভাতা বাবদ মাসে মোটা অংকে ব্যয় থেকে বেঁচে যাবে।
কী ধরনের খাবার বিক্রি করবে?
আগে ঠিক করো, তুমি কোন ধরনের খাবার বিক্রি করতে চাও। এ নিয়ে তোমার এলাকার বা শহরের বাজার জরিপ করেও দেখতে পারো। বিভিন্ন করপোরেট অফিস, কমিউনিটিতে বা স্কুল, কলেজের কান্টিনে কোন ধরনের খাবার বেশি অর্ডার করা হয় একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো । এরপর সিদ্ধান্ত নাও শুধু ফাস্টফুড, নাকি চাইনিজ, থাই, ইতালিয়ান অথবা আমাদের দেশীও, বা দুপুরের খাবার হিসেবে ভাত, মাছ, নাকি বিরিয়ানি, ঠিক কোন ধরনের খাবার তুমি টিফিন পরিসেবায় বিক্রি করবে।
শুরুতেই একাধিক ম্যানু না রেখে গ্রাহকদের চাহিদা বুঝে মেন্যুতে দু চারটা আইটেম রাখলে ভালো হবে পরে নতুন নতুন খাবার যোগ করা যাতে পারে। তুমি কোন এলাকায় ব্যবসাটি করতে চাচ্ছ সেটির ওপর মেন্যু এবং সেবার মূল্য নির্ভর করবে।
রান্নাঘর কোথায় ভাড়া করবে?
রান্নাঘর ভাড়া করতে হবে তোমার ব্যবসা পরিচালনার এরিয়ার কাছাকাছি। যাতে করে সহজে ও দ্রুত পরিসেবাটি সরবরাহ করা যায়। তাছাড়া, জায়গাটি যেন পরিস্কার–পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর হয় এব্যাপারে খুব গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ খাবারের মানই তোমার একমাত্র পরিচয় বহন করবে। অল্প খরচে রান্নাঘর করার জন্য কোন বাড়ি, বাড়ির ছাদ, বা ফ্লাট যাই হোক না কেনো ভালো জায়গা নির্বাচন করতে হবে।
টিফিন পরিসেবার লাইসেন্স লাগে কি?
টিফিন পরিসেবার ব্যবসা শুরু করতে হলে কয়েকটি লাইসেন্স করতে হয় যেমনঃ ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, স্যানিটারি লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, কৃষি উপকরণ সনদ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন সনদ এসব লাইসেন্স নিতে হয়। অনেক সময় বিভিন্ন এজেন্সি দায়িত্ব নিয়ে ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় লাইসেন্স করিয়ে দেয়। যাইহোক প্রাথমিকভাবে ট্রেড লাইসেন্স আর তোমার আধার কার্ড দিয়েও এই ব্যবসা শুরু করতে পারো।
অর্ডার নেয়ার ব্যবস্থা কেমন হবে?
তোমার যদি আগে থেকেই কোন কর্পোরেট অফিস, মার্কেট বা স্কুল-কলেজের ক্যন্টিন গুলোর সাথে টাই আপ হয়ে যায় তবে নিশ্চিন্তে খাবার সরবরাহ করতে পারবে। তবে আজকাল অনলাইনেও খাবার অর্ডার করার বিষয়টিকে মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। সেক্ষেত্রে তুমি নিজেই একটা ওয়েবসাইট খুলে নিতে পারো। আবার ফুড অ্যাগ্রিগেটররাও অর্ডার করতে পারে। সেই সঙ্গে অনলাইন অর্থ পরিশোধের জন্য ভালো মানের পয়েন্ট অব সেল সিস্টেম (পিওএস) থাকা জরুরি। তবে প্রথম প্রথম নিজেই অর্ডার নেয়া ও সরবরাহের দায়িত্ব নিলে তোমার খরচ ও ঝামেলা দুটোই বাড়বে। তাই প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র ফুড ডেলিভারি কোম্পানির ওপর নির্ভর করাই ভালো।
রান্নাঘর ও প্যাকেজিং সরঞ্জাম কেমন হবে?
একটি রান্নাঘরে কী কী লাগে সেটি সম্পর্কে তোমার স্পষ্ট ধারণা না থাকলে যারা এমন ব্যবসার সাথে যুক্ত তাদের পরামর্শ নিতে পারো। খুব ভেবেচিন্তের রান্নাঘরের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে হবে। চিমনি, ফ্রিজার এবং উনুন এগুলোতে একটু বেশি বিনিয়োগ করলে ভালো হয়।
রান্না করার জন্য কাঁচামাল পাইকারী বাজার থেকে কেনার চেষ্টা করলে সাশ্রয় হবে। নিয়মিত এক দোকান থেকে নিলেও ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। এতে প্রয়োজনের সময় পণ্যের ডেলিভারি দ্রুত পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে, পাশাপাশি পণ্য ভালো পেতে পারো। তাছাড়া ভালো সম্পর্ক ও নিয়মিত খদ্দের হিসেবে দোকানদার দামে কিছুটা কমও রাখতে পারে।
এ ব্যবসায় প্যাকেজিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ খাবার দূর দূরান্তে সরবরাহ করতে হয়। অনেক সময় অফিসে বা অন্য কোনও জায়গা থেকে যারা খাবার অর্ডার করেন সেখানে খাবার জন্য প্লেট চামচ ইত্যাদি নাও থাকতে পারে। তাই তাদের কথা মাথায় রেখে বিশেষ প্যাকেজিংয়ের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। তাছাড়া, এমনভাবে প্যাকেজিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে খাবার সহজে নষ্ট না হয় ও গরম থাকে। আর খাবার প্যাকেজিংয়ে ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আনতে পারলে বা আভিজাত্য থাকলে সহজে তুমি ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে।
কর্মী নিয়োগের দরকার আছে কি না?
দক্ষ ও বিশ্বস্ত রাঁধুনী ছাড়া ব্যবসাটির লোকসান নিশ্চিত। রাঁধুনীর ওপরই নির্ভর করবে তোমার ব্যবসার ব্রান্ডিং। তুমি নিজে রান্না করতে পারলে ভালো নইলে শুরুর দিকে একজন রাঁধুনি রেখে দিলে সাথে একজন পরিছন্নতা কর্মী। আর কাজে হাত বাটতে তুমি তো আছোই। একটি হটলাইন এর ব্যবস্থা রাখতে হবে। আর ফোনকল রিসিভ করার জন্য সার্বক্ষণিক কাউকে না কাউকে তো থাকতেই হবে। এটা লোক রেখেও করতে পারো, আবার এ কাজটি নিজেও করা যেতে পারে। যদি নিজেরাই খাবার ডেলিভারির ব্যবস্থা করতে চাও তবে ডেলিভারির জন্য প্রাথমিকভাবে কমিশনে ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
পরিচ্ছন্নতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
এই ব্যবসার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিচ্ছন্নতা। খাবার প্রস্তুত ও প্যাকেজিংয়ে স্বাস্থ্যবিধি (হাইজিন) মেনে চলা অপরিহার্য। কর্মীদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। বিশেষ করে ছোট শহর গুলোর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিজে উপস্থিত থেকে এটি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে রান্নাঘরের কর্মীদের পোশাক নির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে।
খাবার অর্ডারের হিসাব রাখা?
বিভিন্ন জায়গা থেকে যখন ক্রমাগত খাবারের অর্ডার আসতে থাকবে তখন সূক্ষ্ণ ও সতর্কতার সঙ্গে হিসাব রাখা জরুরি। প্রতিটি অর্ডার সময়মতো ডেলিভারি দেয়া নিশ্চিত করতে হবে। একজনের অর্ডার যেন কোনোভাবেই আরেকজনের কাছে না যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনো কারণে ভুল হয়ে গেলে অবশ্যই দ্বিধাহীনভাবে দুঃখ প্রকাশ করে গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এটি আন্তরিকতার পরিচয়, যা তোমার টিফিন পরিসেবার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে।
মার্কেটিং ও প্রচারণা কি করে হবে?
এই ব্যবসা প্রসারের মূলমন্ত্র মানসম্পন্ন ও মজাদার খাবার। মানুষ পছন্দ করলে মুখে মুখে অনেকখানি প্রচার হয়ে যায়। তবে ব্যবসা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য ব্যবসার নামে একটি ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে। চাইলে ইউটিউবে একটি চ্যানেল খুলেও প্রচারণা চালাতে পারো। পাশাপাশি সেখান থেকেও আয় করার সুযোগ আছে। খাবার মেন্যু দিয়ে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন বুস্ট করা যেতে পারে। তাহলে দ্রুত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে।
রেস্টুরেন্টের রিভিউ এবং খাবারের ছবি শেয়ার করার জন্য ক্রেতাকে উৎসাহ দিতে পারো। মাঝে মধ্যে বিশেষ উপলক্ষ্যে বা কোনো উপলক্ষ্য ছাড়াও ছাড়ের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। রিভিউ ও শেয়ারের জন্য এ ধরনের ছাড়ের অফার থাকতে পারে।
ব্যবসায় বিনিয়োগ, আয় ও ব্যয় কেমন?
টিফিন পরিসেবা ব্যবসাটি তুমি ৫০ হাজার রুপি অথবা ১ লক্ষ রুপি বিনিয়োগ করেই গড়তে তুলতে পারো। তাছাড়া খাবার পৌঁছে দেওয়া করমীর বেতন, বাজার খরচ, বাসা ভাড়া খরচ, ব্যবসার প্রমোশন এসব বাদ দিয়েও তুমি ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত আয় করতে পারো।
তুমি যতো বেশি সংখ্যক ফুড ডেলিভারি অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে ততো ভালো। এতে অনলাইনে তোমার ব্যবসার উপস্থিতি বাড়বে। ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে গুগল ম্যাপে ব্যবসার অবস্থান দেখিয়ে দিতে পারো। এতে করে তোমার অর্ডার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকবে।